রাজশাহী সিল্ক শাড়ীর বৈশিষ্ট্য

 আসসালামু আলাইকুম, আশা করি আপনারা সবাই ভাল আছেন। আমি একজন রাজশাহী বিভাগের নাগরিক। আজকে আপনাদের সাথে রাজশাহী সিল্ক এর ইতিহাস সম্পর্কে আপনাদেরকে ধারণা দিতে চায়।

রাজশাহী-সিল্কের-বৈশিষ্ট্য


আজকে আমরা আলোচনা করব রাজশাহী সিল্কের ঐতিহ্য সম্পর্কে এবং রাজশাহী সিল্কের খুঁটিনাটি সব তথ্য জানার চেষ্টা করব এই আলোচনায়। চলুন জেনে নেওয়া যাক রাজশাহী সিল্ক ।

পেজ সূচীপত্রঃ রাজশাহী সিল্কের ইতিহাস

রাজশাহী সিল্কের ইতিকথা

রাজশাহীর সিল্ক ফ্যাক্টরি ছিল একটি মালিকানাধীন কারখানা। ১৯৬১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একসময় বেঙ্গল সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। রেকর্ড অনুসারে , ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রেশম উৎপাদন শুরু হয় । ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকার রেশম উৎপাদন শুরু করে রাজশাহীতে। 
১৯৭৮ সালে এটি রেশম উন্নয়ন বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তবে তখন সিল্কের ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছিল।  তাই দুই হাজার দুই  সালের ৩০ নভেম্বর এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালে এটিকে বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে ভৌগলিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। 

রাজশাহী রেশম আবিষ্কারের ইতিকথা 

রাজশাহী জেলা প্রাচীনকাল থেকে রেশম ও রেশম জাত পণ্য উৎপাদনে ভারতের থেকে শীর্ষে এগিয়ে আছে। রাজশাহীতে উৎপাদিত রেশম পণ্যের নাম রাজশাহী সিল্ক । রাজশাহীতে পাওয়া যায় বলে এর নাম হয়েছে রাজশাহী সিল্ক, রেশম তন্তু দিয়ে তৈরি করা হয় এ কাপড় , শাড়ির কারণে এটি খুব জনপ্রিয়। রেশম অনেক সূক্ষ্ম ও নরম মোলায়েম হয়ে থাকে। গুটি পোকা থেকে রেশম তৈরি হয়। সাধারণত তিন ধরণের রেশম রয়েছে যেমন, তসর সিল্ক, এরি সিল্ক, তুঁতসিল্ক ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে তুঁত রেশম সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। 

রাজশাহী জেলার ঐতিহ্যবাহী সিল্ক শিল্প

রাজশাহী জেলায় অনেক ঐতিহ্যবাহী শিল্প রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্প হচ্ছে রাজশাহী সিল্ক । রাজশাহী জেলায় অধিক রেশন চাষ হওয়ার কারণে রাজশাহীতে সিল্কের শাড়ি তৈরির জন্য বিখ্যাত, সিল্ক কাপড় তৈরির জন্য রেশম পোকা ব্যবহার করা হয়। রেশম চাষ করা একটি জটিল প্রক্রিয়া বিভিন্নভাবে এই রেশনের গুটি পোকা থেকে কাপড়ের সুতা পৃথক করা হয়। 
রেশম গুটি অনেকটা কবুতরের ডিমের মতো দেখতে , রাজশাহীতে উৎপাদিত যেসব কাপড় তৈরি করা হয় সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান কাপড় হল বলাকা সিল্ক। বলাকা সিল্ক কখনো মেশিনে পূরণ করা যায় না , বলাকা সিল্ক অনেক পাতলা হলেও এর  ট্রান্সপারেন্ট হয়না। 
এছাড়াও দেশে বিদেশে সব জায়গায় রাজশাহী সিল্কের অনেক কদর বেড়ে গেছে। রাজশাহী সিল্ক আমাদের একমাত্র ঐতিহ্য রাজশাহী বিভাগ। আমাদের রাজশাহী শহরে অনেকগুলো রাজশাহী সিল্কের কারখানা গড়ে উঠেছে যেমন সপুরা সিল্ক, উষা সিল্ক, রাজশাহী সিল্ক ইত্যাদি। আশা করছি আমরা ভবিষ্যতেও রাজশাহী সিল্কের ঐতিহ্য এইভাবেই ধরে রাখতে পারব।

বর্তমানে রাজশাহী সিল্কের অবস্থা 

বর্তমানে রাজশাহী রেশন কারখানায় এক টন সুতা উৎপাদিত হচ্ছে। যেটা আমাদের জন্য খুবই ভালো একটা খবর। যে কারণে আমরা কারখানায় শাড়ি 5000 টাকার মূল্যেও পাওয়া যাচ্ছে। পাঞ্জাবি ও শার্টের দাম ৮০০ টাকা গজ । দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে রাজশাহী সিল্ক। 
রেশনের উন্নয়নে সরকারিভাবে দেশে ১৩৫ কোটি টাকা কয়েকটি প্রকল্প চালু আছে। কয়েক বছরের মধ্যে রেশমের উৎপাদন বাড়বে। ক্রেতার চাহিদা ও সরকারের সহযোগিতা থাকলে রাজশাহী সিল্কের অবস্থান আরো ভালোভাবে আমরা তৈরি করতে পারব। আপনারা আমরা চাইলেই রাজশাহী সিল্কের অবস্থান আরো ভালো দিকে নিয়ে যেতে পারবো তাই আমরা সবাই মিলে রাজশাহী সিল্কের কাপড় ব্যবহার বাড়িয়ে দিব। 

রাজশাহী সিল্ক শাড়ীর বৈশিষ্ট্য 

রাজশাহি সিল্ক শাড়ী মূলত রেশম তন্তু থেকে তৈরি করা হয়। যার কারনে শাড়ীগুলো অনেক নরম,মলায়েম হয়। নিচে রাজশাহী সিল্ক শাড়ীর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল 
  • রাজশাহী সিল্ক শাড়ী গুনগত মানের দিক থেকে অনেক উন্নত আর টেকসই 
  • এই শাড়ীগুলো পড়তে অনেক আরামদায়ক ও অনেক অল্প ওজনের
  • রাজশাহী সিল্ক শাড়ী তে নকশাগুলো অনেক আকর্ষণীয়
  • এই শাড়িগুলো অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয় 
  • রাজশাহী সিল্ক সুতা গুলো অনেক বেশি তাপ সহনশীল ক্ষমতা রাখে।
  • রাজশাহী সিল্ক শাড়ি দেশে-বিদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে
  • এই শাড়িগুলো বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য উপযুক্ত একটি শাড়ি

রাজশাহী সিল্কের জনপ্রিয়তা শীর্ষে থাকার কারণ

বাংলাদেশের উন্নয়নে রাজশাহীর রেশম শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। । রাজশাহী সিল্কের প্রধান উপাদান হলো রেশম । রাজশাহী সিল্ক রপ্তানিতে ভারতবর্ষের যে কোন অঞ্চলের থেকে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। রাজশাহী সিল্ক প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হান্টার বলেছেন, 'রাজশাহী জেলায় রেশম সুতা প্রস্তুত এবং রেশম বস্ত্র বয়ন বহু শতাব্দী পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে'। 
রাজশাহী শহরের পদ্মা নদীর তীরে একটি বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন করে ওলন্দাজ বণিকেরা। যেটা পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় বড়কুঠি। রাজশাহী সিল্কের মূল উপাদান হলো রেশম। রেশমের মধ্যে সুখাতুত্রেশন দিয়ে তৈরি হয় এটি তেমন নোংরা হয় না পরিষ্কার করা সহজ এবং এটি রাজশাহী সিল্কের পরিবেশ খুব সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান রাখে।
রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া, নাটোর, চারঘাট, মীরগঞ্জ ,কাপাসিয়া , তাহেরপুর এসব নদী বন্দর কার্পাস সুতা ও রেশম এবং বস্ত্র কেনাবেচার জন্য বিখ্যাত ছিল। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে এদেশে ইউরোপীয় বণিকেরা আসা শুরু করে। রাজশাহী সিল্ক শাড়ির নমনীয়তা, ব্যবহারে আরামদায়কতা ,সৌন্দর্যের দিক দিয়ে , ঐতিহ্যের দিক দিয়ে বিচার করলে রাজশাহী সিল্ক শাড়ি ভোক্তাদের কাছে পেয়েছে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা।  
বছরজুড়ে এই সিল্ক শাড়ির চাহিদা থাকে। রাজশাহী সিলকাটি হওয়ার কারণে এবং কোয়ালিটি ভালো হওয়ার কারণে কেতাগণ রাজশাহী সিল্ক কিনে থাকেন। দামে সহজলভ্য হওয়ায় পরিবারের সকল আত্মীয়-স্বজনের জন্য নিজেদের জন্য রাজশাহী সিল্কের পণ্য মানুষ কিনে থাকে।

রাজশাহীর কয়েকটি সিল্ক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম

রাজশাহী নগরীতে অনেকগুলো রেশম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম নিচে দেওয়া হল
  1. সপুরা সিল্ক
  2. আমেনা সিল্ক
  3. রাজশাহী সিল্ক ফ্যাশন
  4. মহানন্দা সিল্ক
এছাড়াও আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এখন আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে। সময়ের সাথে সাথে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ পোশাকগুলো তৈরি হয়ে আসতেছে। এই সিল্ক এর প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার নিজস্ব ব্র্যান্ডেই নিজেদের শোরুমের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। রাজশাহী ছাড়াও চট্টগ্রাম এবং ঢাকা শহর দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বিভিন্ন সিল্ক শোরুম রয়েছে যেগুলোতে রাজশাহী সিল্কের পোশাক রাখা হয়। তবে এগুলো রাজশাহী থেকে পরিচালিত হয়।

আরো পড়ুনঃ

সিল্ক চাষের পদ্ধতি

রেশম বা সিল্কের চাষ একটি কঠিন প্রক্রিয়া। রেশম চাষ হতে কাপড় তৈরি হয়। বিভিন্ন ধাপে রেশম সুতা তৈরি করা হয়। প্রথমে তুত গাছ চাষ করতে হয় তারপর সে সম্পর্কে পালন করতে হয় এবং রেশম গুটির সুতা পৃথক করা হয় কাপড় তৈরির জন্য। রেশম কুটি দেখতে অনেকটাই কবুতরের ডিমের মতো। 
রেশম কুটির আরেকটি নাম আছে সেটা হল কোকূণ যার মধ্যে ৫০০ মিটারেরও বেশি সুতা থাকে। এটি তৈরি হতে তিন দিন সময় লাগে। গুটি পোকাটিকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে রেশম সুতা সংগ্রহ করতে হয়। তাছাড়া সুতার গুণগত মান সুন্দর থাকে না। 

আরো পড়ুনঃ

রাজশাহী সিল্কের শাড়ির কথা

রাজশাহী সিল্ক শাড়ির কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই অঞ্চলে অধিক রেশম চাষ হওয়ার কারণে রাজশাহীকে বেছে নেয়া হয়। রেশম দিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় শাড়ি তৈরি করা হয় যার নাম গরদের শাড়ি বলে পরিচিত। এই শাড়ি শুধুমাত্র রাজশাহীতেই পাওয়া যায়।স্বাভাবিক রঙের রেশমি কাপড় যখন হাড়ের পানিতে ধোঁয়া হয় তখন তার নাম হয়ে যায় গরদ গরদের শাড়ি পাড়ের রং যে রকমই হোক না কেন শাড়ির জমিন হাতির দাঁতের বর্ণ হয়ে থাকে। 

উৎপাদনের মধ্যে রাজশাহীতে সবচেয়ে দামি সিল্কের নাম হলো বলাকা সিল্ক। এই শাড়ি তৈরিতে অনেক খাটাখাটনির প্রয়োজন হয়। মূলত টুইস্টিং মেশিনের মাধ্যমে এই বলাকা সিল্ক শাড়ি তৈরি করা হয়। এটা কখনো মেশিনে বুনন করা যায় না।বলাকা সিল্ক শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা হ্যান্ডলুম কাপড়। বলাকা সিলক অনেক পাতলা এবং হালকা হয়ে থাকে। তারপরও এই শাড়িটি পাতলা হলেও ট্রান্সপারেন্ট নয়, পরে আরাম পাওয়া যায়। এই সিল্কের বুনন অনেক ভরাট ও শক্ত। দেশে বিদেশে রাজশাহী সিল্কের শাড়ির কদর অনেক বেশি। আমি একজন রাজশাহীর মানুষ হিসেবে রাজশাহী সিল্কের উন্নয়ন কামনা করছি।

লেখক এর মন্তব্যঃ রাজশাহী সিল্ক রাজশাহীবাসীর গর্ব 

আশা করি, এই আর্টিকেলটিতে রাজশাহী সিল্ক সম্পর্কে অনেকটাই ধারণ আপনাদেরকে দিতে পেরেছি আমি মনে  করি এই কনটেন্টটি পড়লে আপনার অনেকটাই জ্ঞান অর্জন হবে। এছাড়াও আমি একজন রাজশাহীর নাগরিক। 
একজন রাজশাহীর মানুষ হিসেবে বলতে চাই রাজশাহী সিল্ক আমাদের কাছে একটা ঐতিহ্যবাহী শিল্প, যেটির মাধ্যমে আমরা দেশে-বিদেশে রাজশাহীর ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পৌঁছে দিতে পেরেছি। রাজশাহী সিল্ক নিয়ে আমাদের রাজশাহীবাসীরা অনেক গর্ববোধ করি। আমরা চাই এই সুনাম এই খ্যাতি আমরা সারা জীবন ধরে রাখতে পারব ইনশাআল্লাহ। 






এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডেইলি লাইফস্টাইল অ্যান্ড হেলথ্ এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url